বাংলাদেশের আয়কর আইন ২০২৩


 বাংলাদেশের আয়কর আইন ২০২৩ (Income Tax Ordinance, 1984-এর সংশোধিত রূপ) একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন, যা দেশে আয়কর সংগ্রহের পদ্ধতি এবং এর সংক্রান্ত নিয়মাবলী নির্ধারণ করে। এই আইনটির মাধ্যমে সরকার নাগরিকদের আয়, সম্পদ এবং অন্যান্য আর্থিক লেনদেনের উপর কর আরোপ করে, যা রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের উৎস হিসেবে কাজ করে।

১. আইনটির উদ্দেশ্য ও প্রেক্ষাপট

আয়কর আইন ২০২৩-এর মূল উদ্দেশ্য হলো:

  • রাষ্ট্রের আয় বৃদ্ধির জন্য একটি সুশৃঙ্খল কর ব্যবস্থা গঠন করা।
  • করদাতাদের সঠিক তথ্য প্রদান এবং তাদের অধিকার ও দায়িত্ব স্পষ্ট করা।
  • কর ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা এবং ন্যায্যতা নিশ্চিত করা।

২. আইনটির কাঠামো

২.১. সংজ্ঞা

আইনটিতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শব্দ ও শব্দগুচ্ছের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, যেমন:

  • করদাতা: যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আয়কর দিতে বাধ্য।
  • আয়: যে কোনো ধরনের আয়, যা কর্মসংস্থান, ব্যবসা, বা অন্যান্য উৎস থেকে আসতে পারে।

২.২. করদাতাদের শ্রেণীবিভাগ

আইন অনুযায়ী করদাতাদের শ্রেণীবিভাগ করা হয়েছে:

  1. ব্যক্তি: একজন প্রাকৃতিক ব্যক্তি, যার আয় নির্ধারিত সীমার মধ্যে আসে।
  2. প্রতিষ্ঠান: কোনো ব্যবসা বা সংস্থা, যার আয় বা মুনাফা রয়েছে।

৩. করের হার ও স্ল্যাব

২০২৩ সালে আয়কর আইন অনুযায়ী, ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের জন্য করের হার ও স্ল্যাব নির্ধারণ করা হয়েছে।

৩.১. ব্যক্তি করদাতাদের জন্য

  • ৩ লাখ টাকার নিচে: শূন্য শতাংশ।
  • ৩ লাখ থেকে ১২ লাখ: ১০ শতাংশ।
  • ১২ লাখ থেকে ৩০ লাখ: ১৫ শতাংশ।
  • ৩০ লাখ থেকে ৭৫ লাখ: ২০ শতাংশ।
  • ৭৫ লাখের উপরে: ২৫ শতাংশ।

৩.২. প্রতিষ্ঠান করদাতাদের জন্য

  • স্বাভাবিক কর হার: ২৫ শতাংশ।
  • বিশেষ ক্ষেত্রে (যেমন: শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য) ২০ শতাংশ।

৪. করের অবকাশ ও ছাড়

আয়কর আইন ২০২৩-এ বিভিন্ন ধরনের কর অবকাশ ও ছাড়ের সুযোগ রয়েছে। যেমন:

  • শিক্ষাগত খরচে ছাড়।
  • স্বাস্থ্যসেবার জন্য ব্যয় হলে কর অবকাশ।
  • বিভিন্ন সামাজিক ও পরিবেশগত প্রকল্পে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ছাড়।

৫. কর প্রদানের পদ্ধতি

আয়কর দেওয়ার পদ্ধতি সহজ ও দ্রুত করতে সরকার বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে কর প্রদানের ব্যবস্থা করেছে। করদাতারা এখন ইন্টারনেট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং এবং অন্যান্য ডিজিটাল মাধ্যমের মাধ্যমে সহজে তাদের কর পরিশোধ করতে পারেন।

৬. তথ্য প্রদান ও রেকর্ড সংরক্ষণ

করদাতাদের তাদের আয় এবং অন্যান্য আর্থিক লেনদেনের সঠিক তথ্য প্রদান করা বাধ্যতামূলক। এছাড়াও, করদাতাদের তাদের লেনদেনের রেকর্ড অন্তত পাঁচ বছর সংরক্ষণ করতে হবে।

৭. শাস্তির বিধান

আইনটি অমান্য করলে শাস্তির বিধানও রয়েছে। যেমন:

  • অবৈধ তথ্য প্রদান করা হলে জরিমানা।
  • সময়সীমা অতিক্রম করে কর পরিশোধ না করলে অতিরিক্ত ফি।

৮. অভিযোগের নিষ্পত্তি

করদাতাদের অভিযোগের নিষ্পত্তির জন্য একটি সঠিক প্রক্রিয়া রয়েছে, যার মাধ্যমে তারা নিজেদের আপত্তি জানাতে পারবেন এবং যথাযথ বিচার পাবেন।

৯. আন্তর্জাতিক কর ব্যবস্থা

বাংলাদেশ সরকারের আন্তর্জাতিক কর সংক্রান্ত বিভিন্ন চুক্তি এবং সুশৃঙ্খল নীতিমালা রয়েছে, যা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য সুবিধাজনক।

১০. উপসংহার

বাংলাদেশের আয়কর আইন ২০২৩ একটি সুসংহত এবং সমৃদ্ধ আইনি কাঠামো প্রদান করে, যা দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সহায়ক। এটি রাষ্ট্রের রাজস্ব আহরণের পাশাপাশি, নাগরিকদের আর্থিক অধিকার ও দায়বদ্ধতা স্পষ্ট করে। আইনটি সরকারের উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং একটি স্বচ্ছ, সুষ্ঠু ও ন্যায়সঙ্গত কর ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি দেয়।

Post a Comment

Previous Post Next Post