বাংলাদেশের আয়কর আইনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস/ A brief history of income tax law in Bangladesh

 


আয়কর সরকারি রাজস্বের একটি অন্যতম প্রধান উৎস হিসেবে বিবেচিত। আইনের সাহায্যে এ উৎস থেকে আয় আদায়ের জন্য বঙ্গ ভারতে ১৮৬০ সালে প্রথকম আয়কর আইন প্রবর্তিত হয়েছে। তৎকালীন বৃটিশ সরকার ইংল্যান্ডে প্রচলিত আয়কর আইন অনুসরণ করে সর্বপ্রথম এ আইন চালু করে। যার নামকরণ করেন ‘আয়কর আইন ১৮৬০’।

উপযুক্ত আয়কর আইন ১৮৬৫ সাল পর্যন্ত এক নিয়মে ৫ বছর কার্যকর থাকার পর রাজনৈতিক এবং আর্থসামাজিক বিবর্তনের প্রেক্ষাপটে বিলুপ্ত করা হয়। পরবর্তীতে বাজেটের মধ্যে সংকট দেখা দেয়ায় ১৮৬৭ সালে কিছুটা পরিবর্তন করে আয়কর আইন ‘লাইসেন্স ট্র্যাক্স এ্যাক্ট-১৮৬৭’ নামকরণে পুনরায় প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৮৬৮ সালে উক্ত আয়কর আইনের নাম পরিবর্তনের মাধ্যমে ‘সার্টিফিকেট এ্যাক্ট-১৮৬৮’ নামে নামকরণ করা হয়। এ সময় করের হারকে হ্রাস, করমুক্ত নির্দিষ্ট সীমা ধার্য ও কৃষি আয়বে কর বহির্ভূত হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

সার্টিফিকের এ্যাক্টকে পরিবর্তনের মাধ্যমে ১৮৬৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে ‘আয়কর আইন’ নামে একটি আইন পাশ করা হয়। এতে কৃষি আয়কে আবার আয়করের মধ্যে অন্তর্ভূক্তি করা হয়। আয়কর আইনকে ১৮৭৩ সালের ১লা এপ্রিল আবার স্থগিত করা হয়। ১৮৭৬ থেকে ১৮৭৮ সাল পর্যন্ত ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কারণে ১৮৭৭ সালে উক্ত আয়কর আইনকে ‘লাইসেন্স এ্যাক্ট-১৮৭৭’ নামকরণে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করা হয়। নানাবিধ পরিবর্তনের মাধ্যমে উক্ত আইন. ১৮৮৬ সাল পর্যন্ত কার্যকর ছিল।

নানাবিধ প্রয়োজনে তহবিল প্রবৃদ্ধির জন্য তৎকালিন বৃটিশ সরকার ‘আয়কর আইন-১৮৮৬’ আবার প্রবর্তণ করেন। এ আইনে কৃষি আয়ের সংজ্ঞাসহ এর নানাবিধ মওকুফগুলো ব্যাখ্যা করা ও জীবন বীমা প্রিমিয়ামের উপর সর্বোচ্চ অংশ পর্যন্ত কর মওকুফ করা হয়।

একই নিয়মে উক্ত আইন ১৯০৩ সাল পর্যন্ত কার্যকর ছিল। ১৯০৩ সালে এর অল্প কিছু নিয়ম পরিবর্তন করা হয়। ১৯১৬ সালে দ্বিতীয় বারের মত উক্ত আইনের আরও কিছু পরিবর্তন সাধন করা হয়। ১৯১৮ সাল পর্যন্ত যা কার্যকর ছিল। ১৯১৮ সালে সাবেক আয়কর আইনকে গুরুত্বপূর্ণভাবে সাজানো হয় ও ‘আয়কর আইন-১৯১৮’ হিসাবে নতুন আয়কর নামকরণ করা হয়। সে আইনেই সর্বপ্রথম আয়করের হার নিরূপণের লক্ষ্যে সমস্ত আয়ের উৎসের যোগফল বের করার প্রথা প্রবর্তিত হয় ও করযোগ্য আয়ের উপর কর ধার্য প্রথা প্রচলন করা হয়। এখানে কর ধার্য করার লক্ষ্যে আয়কে ৬ টি খাতে বিভাজ্য করা হয়। যথাঃ

১. বেতন; ২. সিকিউরিটির উপর সুদ; ৩. গৃহ-সম্পত্তি থেকে আয়; 4. ব্যবসা থেকে আয়; ৫. পেশাগত উপার্জন থেকে আয়; ৬. নানাবিধ উৎস থেকে আয়।

এ আইনও শেষ পর্যায়ে অসম্পূর্ণ ও অপর্যাপ্ত হিসাবে অভিহিত করা হয় এবং আয়কর প্রশাসনকে কেন্দ্রীভূতকরণের উদ্দেশ্যে এর বাস্তব উন্নয়ন প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

তারপর প্রাদেশিক কমিটিসমূহ আয়কর আইনের সর্বাঙ্গীন সংশোধন, সংস্কার, পরিবর্ধন এবং মান উন্নয়নের জন্য ব্যাপক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার পরিকল্পনা গ্রহণ করে ও সে অনুসারে একটি সর্ব ভারতীয় কমিটি তৈরি করা হয়। উক্ত কমিটির তথ্যের উপর ভিত্তি করে বিস্তারিত রিপোর্টের সুপারিশ অনুযায়ী ১৯২২ সালে ‘আয়কর আইন-১৯২২’ হিসাবে প্রবর্তন করা হয়।

1922 সালে আয়কর আইন ভারত বিভাজ্যের পর ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই গ্রহণ করে। 1922 সালের আয়কর আইন বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কার্যকর ছিল। 1922 সালের আয়কর আইন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর গ্রহণ করা হয়। তারপর প্রয়োজন অনুসারে এ আইনের কতিপয় সংশোধন ও পরিবর্তন-পরিবর্ধন করা হয়।

কালের আবর্তন ও গত কয়েক যুগের রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক বিবর্তনের জন্য ১৯২২ সালের আয়কর আইনের কতিপয় সংশোধন এবং পরিবর্তন করা হয়। তথাপি এতে আয়কর আইনে  বিভিন্ন প্রকার জটিলতার প্রবৃদ্ধি ঘটে ও করদাতারা বিভিন্ন প্রকার অসুবিধার মোকাবেলা করতে থাকে ও কর ফাঁকি দিতে থাকে। তাই নানাবিধ ত্রুটি বিচ্যুতি দুর করে আয়কর আইনকে সম্পূর্ণভাবে নতুন করে তৈরির লক্ষ্যে 1976 সালে বাংলাদেশ সরকার একটি ‘কর অনুসন্ধান কমিশন’ সৃষ্টি করেন। এ কমিশন নানা স্তারের জনসাধারণের কাছ থেকে আয়কর আইন সংশ্লিষ্ট অভিমত গ্রহন করেন। 1922 সালের আয়কর আইন বাতিল করে কর অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশের প্রেক্ষাপটে ১৯৮৪ সালে একটি নতুন আইন প্রবর্তন করা হয়। এ আইনই ‘আয়কর অধ্যাদেশ-1984’ নামে পরিচিত। 1984 সালের 1লা জুলাই এ নতুন আইন কার্যকরী করা হয়। ২২ জুন ২০২৩ তারিখে পাশ হয় আয়কর আইন ২০২৩।

আয়কর আইন মোটামুটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। এর পরিধি ও উপাদানসমূহ নিম্নরূপঃ

  • আইন, ২০২৩ এর আয়কর আইনঃ এই আইন ২০২৩ সালের ১২নং আইন হিসেবে ২২ জুন ২০২৩ তারিখে পাশ হয়। উক্ত আইনে ২৫ টি অংশ রয়েছে। ৩৪৫ টি ধারা ও ৮ টি তফসিল রয়েছে। এই আইনে কর কাঠামো, আয় নির্ধারণ ও করধার্য প্রণালী সম্পর্কীয় বিধানগুলো অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে।
  • ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশঃ এই আইনে কর কাঠামো, আয় নির্ধারণ ও করধার্য প্রণালী সম্পর্কীয় বিধানগুলো অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। যা ইনকাম ট্যাক্স ম্যানুয়েলের প্রথম অংশে লিপিবদ্ধ আছে।
  • আয়কর বিধানাবলীঃ কর বিভাগ যাতে উপরোক্ত বিধানগুলো কার্যকরভাবে প্রয়োগ করতে পারে তার জন্য আয়কর অধ্যাদেশের ১৮৫ ধারায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডেকে অনুরূপ আয়কর সংক্রান্ত বিধানাবলী প্রণয়ন করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে এবং ৬৭ টি বিধানাবলী প্রণয়ন করা হয়েছে ও অনেক বিধানাবলী সংশোধিত হয়েছে। বর্তমানে ১০৭টি বিধি কার্যকর আছে। এই বিধানাবলী আয়কর অধ্যাদেশের ধারাগুলোর ন্যায় সমভাবে প্রযোজ্য। সুতারাং আয়কর আইন বলতে সংশ্লিষ্ট আয়কর বিধানাবলীকেও বুঝায়।
  • অর্থ আইন বা অধ্যাদেশঃ সরকার প্রত্যেক বছর করের হার নিরূপণ ও আয়কর আইনের কিছু কিছু বিধানাবলীর সংশোধন অর্থ আইনের মাধ্যমে করে থাকে।
  • বিভিন্ন মোকদ্দমার রায়ঃ বিভিন্ন মোকদ্দমার রায়ের উচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারপতিগণ আয়কর আইন সংক্রান্ত যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাও আয়কর আইনের অন্যতম উপাদান।
  • বিজ্ঞপ্তি ও নির্দেশাবলীঃ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিভিন্ন সময়ে আয়কর সংক্রান্ত নির্দেশনামা প্রদান করে ও তৎসংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি জারি করে। এ সকল উপাদানের সমন্বয়ে আয়কর সংক্রান্ত সমগ্র আইন গঠিত।

Post a Comment

Previous Post Next Post